কামাল লোহানী
আমাদের দেশের বিরোধী ১৮টি দলের নেত্রী মাদাম খালেদা জিয়া আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে সরকারের নামে নালিশ করে বোধহয় ‘বালিশ’ পেয়েছেন। সেই বালিশ ফাটিয়ে ফেলেছেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার জনসভায়। ফাটা বালিশের তুলো উড়িয়ে কী অসাধারণ উক্তিই না করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আগামী ৪২ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’... এই না হলে দেশের নেত্রী, দলের ম্যাডাম! কী চমৎকার হিসেব-নিকেশ কষে বলেছেন ৪২ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ২০ নয়, ৩০ নয় ৪০ও নয়, একেবারে নিখুঁত হিসেব করে ৪২ বছর পেলেন কোত্থেকে? এ হিসেব কোথাকার, কে দিয়েছে? সত্যিই সাধুবাদ দিতে হয় তাঁকে, কী চমৎকার অঙ্ক মিলিয়েছেন তিনি। এতদিন পর্যন্ত কোন নেতাই বলার সাহস করেননি, এই তো সেদিন হিলারির সঙ্গে ‘গুফতোগু’ হওয়ার পর নিখুঁত হিসেব জনগণের সামনে তুলে ধরলেন মাদাম জিয়া। একথা তাঁর মুখেই মানায়, কারণ তিনিই একমাত্র মহিলা। যিনি সামরিক জান্তা প্রধান জেনারেল জিয়ার হত্যার সুযোগে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বিকৃত তথ্য ও অসত্য ভাষণ দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে নির্বাচনে ভোট পাবার কসরত চালাচ্ছেন। অথচ জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকার সময় বঙ্গভবনে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে অভ্যাগত তিন ভদ্রমহিলা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সঙ্গে কথা বলছিলেন না খালেদা, এতই লাজুক ছিলেন। মিশুক ছিলেন না। এমন দৃশ্য দেখে দূরে অতিথিদের সঙ্গে আলাপরত জিয়া তাঁর স্ত্রী খালেদাকে কিছু একটা বলার জন্য তাঁর কাছে যান এবং বলে আবার অতিথিদের কাছে চলে আসেন। পরে ঐ ভদ্রমহিলাদের একজনার কাছ থেকে শুনেছিলাম, খালেদা জিয়া কথা না বলে দূরে একা দাঁড়িয়ে থাকায় জিয়া এসে তাঁকে শাসনের সুরে ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলেন। সেই খালেদা জিয়াই আজ হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ‘৪২ বছর’-এর মতন তার স্বপ্নের কথা বললেন। বলবেনই তো, এখন তো তিনি জিয়ার স্ত্রী সুবাদে রাজনীতি-সংসদীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকায় সাময়িক কিছু চমক দিয়ে জিয়া ভোলাতে চেয়েছিলেন মানুষকে। দেশবাসীও মেজর থেকে জেনারেল হওয়া জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও সময়কালীন কাহিনী-কর্মকা- কিছুই জানতেন না বলে জিয়াকে খুব সহজভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। তার পেছনে আরও একটি কারণ ছিল, সে হলো, মেজর জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে তাঁর জোয়ানদের নিয়ে পাকিস্তান থেকে সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়া জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার হুকুম তামিল করার জন্যই চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে ব্যারিকেড দেখে এগুতে না পেরে বন্দর শ্রমিকদের গালিগালাজ করেছিলেন এবং বন্ধুর মাধ্যমে বাঙালিদের ‘ডিসআর্ম’ করার খবর পেয়ে পালাবার সিদ্ধান্ত নেন। সীমান্ত অভিমুখে রওনা হন কিন্তু গ্রামবাসীরা পথরোধ করে ওদের পালাবার পথ বন্ধ করে দেন। ফলে ফটিকছড়িতেই থাকতে হয়েছিল। এদিকে বেতার ও শহরের সংস্কৃতি কর্মীরা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে পূর্ববাংলার শোষণ মুক্তির ঘোষণা দেন উপাধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। পক্ষে বক্তৃতা করেন সাংবাদিক আব্দুস সালাম। আরও কেউ কেউ। কিন্তু বেতার কর্মীদের মধ্যে সচেতন যাঁরা, তাঁরা ভাবলেন এই যুগসন্ধিক্ষণে একজন বাঙালি সামরিক অফিসারের কণ্ঠে যদি কোন আহ্বান বা তাদের সমর্থনের আভাস দেয়া যায় তবে বিপর্যস্ত বাংলার জনগণের প্রত্যয় সুদৃঢ় হবে। তাই বেতার উদ্যোক্তাদের একজন বেলাল মোহাম্মদ গিয়ে আশ্রিত গ্রাম থেকে তাঁকে শহরে নিয়ে আসেন। তাঁকে অনুরোধ করা হলে তিনি সুযোগ পেয়ে ‘আর্মি ক্যু’র ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এতে সাধারণভাবে বেতার সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী ও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী নেতাদের উদ্যোক্তারা বিব্রতবোধ করলেন। তাঁকে ডেকে আনাই হলো বাঙালি সৈন্যরাও এই বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সমর্থন করছেন, তা জানিয়ে দেয়ার জন্য। অথচ তিনি সুযোগ বুঝে ‘প্রভিশনাল সরকার’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বেতার সংগঠকরা তো বটেই তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে এটা ক্যু নয়, এ মুক্তিযুদ্ধ। এমনকি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে শিল্পমন্ত্রী একে খান এম আর সিদ্দিকীকে ডেকে বলেছিলেন, তাকে গিয়ে বলো, এটা আর্মি ক্যু নয়, রাজনৈতিক যুদ্ধ।
বহু কসরতের পর বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যে বিপ্লবী শব্দ ছিল, তা বাদ দিতে বললেন এবং তারপর একাত্তরের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মহান নেতা মেনে তাঁর নামেই স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করেছিলেন। ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ আমরা সবাই মেনে নিয়েছি, কিন্তু বিএনপি দাবি করছে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক’ এবং ২৬ মার্চ জিয়া এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। অবশ্য জিয়া জীবদ্দশায় তাঁর কোন বক্তৃতা বা লেখায়ও এমন দাবি কখনও করেননি। আর আওয়ামী লীগ কেন দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন এ দাবি অসত্য, অসার। কারণ যে কোন মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার লড়াই কিংবা বিপ্লব যেভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তা থেকে আমরা যা অনুধাবন করি যে, এমন কোন ঘোষণা সুনির্দিষ্টভাবে সেদিন আসেনি বা মেলেনি কোনভাবেই। মুক্তিযুদ্ধ বা বিপ্লব শুরু হয় সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই। একাত্তরে এমন কোন সিদ্ধান্ত ছিল কি? একাত্তরের মার্চ ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে উত্তাল এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল জনসাধারণ তাই রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে দারুণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তার পেছনে সবচেয়ে বড় এবং তাৎক্ষণিক কারণ ছিল, সামরিক শাসকদের দেয়া সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অকল্পনীয় বিজয় জাতীয় ও পূর্ববঙ্গ পরিষদে কিন্তু পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক শক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানী রাজনীতির প্রাসাদ ও সামরিক চক্রান্তকারী সিন্ডিকেটের ছিল না। কারণ যেভাবেই হোক তারা পূর্ববঙ্গের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি ছিল না। তাই কথা দিয়েও শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ করতে চায়নি। ফলে মানুষের মনে জমে ওঠা ক্রোধের সঙ্গে ন্যায্য অধিকার না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতি মিলে দেশবাসী বাংলার জনগণকে মুক্তির পথে হাঁটতে বাধ্য করেছিল। অর্থাৎ রাজনৈতিক পথপরিক্রমায়ই তো এই বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি। যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বই ‘সর্বজনগ্রাহ্য’ বিশেষ করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। তাই রাজনীতিই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল এবং দেশের সকল মানুষই এ ভূমিকায় প্রধান শক্তি বা নায়ক। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মুক্তিযুদ্ধ তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। বাংলার অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ঐ সময় বাংলার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে অনিশ্চিত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থাকে যূথবদ্ধ উদ্দেশ্যে নিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে সহায়তা কামনা করেন। কিন্তু এই উদ্যোগ আওয়ামী লীগে মুশতাক সমর্থক এবং যুব ও ছাত্র নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চাইল না। এমনকি তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রীকে হিসেবে গ্রহণ করতে চাইল না। চ্যালেঞ্জ করতে আগরতলায় দলের বিশেষ অধিবেশন কাউন্সিল ডেকে বসলেন। কিন্তু সংগঠন পর্যায়ে তাজউদ্দিনের যে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা এবং জনপ্রিয়তা ছিল, বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হিসেবে, তার কাছে অনাস্থা উত্থাপনকারীরা হেরে গেলেন।... বহু চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাজউদ্দিন আহমদই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘সচিবালয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন মন্ত্রিসভার অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যৌথভাবে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে সরাসরি রণাঙ্গনে মুক্তি সেনাদের সঙ্গে থেকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এই পর্যায়ে দেশ এবং পরদেশেও তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিসমাপ্তির পথে নিয়ে গিয়েছিলেল এই তাজউদ্দিন আহমদই। আমরা তাঁর নেতৃত্বেই বিজয়ী হয়েছি এ কথা অনস্বীকার্য।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খোন্দকার মুশতাকরা ফাঁক-ফোকর খুঁজে ভেতরটাকে ‘ফোকলা’ করে দেবার যে তৎপরতা চালিয়েছিল, তাজউদ্দিন সাহেবের দৃঢ় মনোবলের এবং মুক্তিফৌজের অসম সাহসিকতা ও বিজয়াভিযানের ফলে তাকে ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিল বটে, কিন্তু পরাশক্তি ঐ সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার কোন মুক্তিযুদ্ধকেই কোনদিন সমর্থন জানায়নি, তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও প্রবল বিরোধিতা করেছিল। মুক্তি ফৌজের বিজয়ে আপাতদৃষ্টিতে মার্কিনীরা পিছিয়ে গিয়েছিল, তা বলা যাবে না। বরঞ্চ গোপনে খাল কাটছিল। তারই ফসল হিসেবে দেখলাম, ধর্মনিরপেক্ষতার সেøøাগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিজয় অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামী দেশগুলোর সম্মেলনে যোগ দিতে বাধ্য হলেন। মুক্তিযুদ্ধের চিরশত্রু আমেরিকান প্রশাসন-শাসকগোষ্ঠী যেন পেয়ে বসলো বাংলাদেশকে। আর বিগত চল্লিশ বছরে কত না ফন্দিতে নবীন রাষ্ট্র ও নেতৃত্বকে কতভাবে বেকায়দায় ফেলে কব্জা করার মতলব এঁটেছে। আজ তারই খেসারত প্রতিনিয়ত দিয়েই চলেছি। ...ওদের চরিত্র দুধারী তলোয়ারের মতন অথবা ‘দোদিল বান্দা’র বলা যায়। ‘চোরকে চুরি করতে বলে গেরস্থকে সজাগ থাকতে বলে।’ দুনিয়ার সর্বত্রই একই নীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে বিক্রি করার জায়গা খুঁজতেও ওদের যুদ্ধের প্রয়োজন। তাই যুদ্ধ বাঁধিয়ে দুই দেশকেই যুদ্ধাস্ত্র সাপ্লাই দিতে ওস্তাদ। সেই আমেরিকান প্রশাসন আজও আরামসে ঘাড় মটকে খেয়ে যাচ্ছে। তাদেরই বর্তমান চক্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এসেছিলেন চীন আর ভারত সফরে। মাঝখান দিয়ে বাংলাদেশেও ঢুঁ মেরে গেছেন। এই সুযোগ নিয়ে খালেদা জিয়া ‘নালিশ’ করেছেন সরকারের বিরুদ্ধে।... আচ্ছা, মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, বিদেশের কাছে নিজেদের ‘হাঁড়ির খবর’ বলে আমরা কি লাভ পাই, কিন্তু কেন করেন? এতে কি দেশের সম্মান বাড়ে? যদি না বাড়ে তবে কেন জনগণকে এভাবে অপমান করেন? মনে রাখবেন, জনগণ অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত। চোখ বন্ধ করে থাকবেন না। ভাববেন না, চোখ যখন বন্ধ এখন কেউ দেখতে পাচ্ছে না।... আমরা কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। কারণ আমাদের কোন সার্থকতা নেই, কিন্তু আপনারা তো ক্ষমতাকে টার্গেট করেই রাজনীতিও করেন। ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া আর কোন কথা ভাবতেও পারেন না। আর ক্ষমতায় যাবার জন্যে যা খুশি করতে আপনাদের বাধে না। সে কারণে যার যা খুশি তাই বলেন, একে অপরের বিরুদ্ধে। নিজের দেশের প্রতি যদি সত্যিই আনুগত্য থাকে তবে কেন অন্যের ওপর নির্ভর করেন? কেউ টাকা না দিলে দেশ চলবে না এটা মনে জায়গা পায় কেন? আমরা কি আদৌ দরিদ্র। না রাজনৈতিক কারণে গরিব বানিয়ে রাখা হয়েছে?
এমনই মানসিকতা আপনাদের মনে বাসা বেঁধেছে। কারণ আপনারা রাষ্ট্র পরিচালনা ও ক্ষমতারোহণ করার মদদ বা শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থেকেই পেতে চান। কখনও বা মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরব ও প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থসম্পদ বোধহয় আপনাদের আকৃষ্ট করে। তাই আপনারা একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ করে ফায়দা হিসেবে ক্ষমতায় গেলে তাদের সাহায্য নিয়ে যেন কাজ করতে পারেন। ...সে কারণেই দেখি, মার্কিনীরা মন্ত্রী বা তস্য মন্ত্রী কিংবা আন্ডার সেক্রেটারি যখন আসেন, তথা ক্ষমতাসীন সরকার যেই থাকে, তারাই উন্মাদ হয়ে যান। কত যে নিরাপত্তাই না নেয়া হয়, কত যে তার স্তর থাকে! তাতেও ভরসা পায় না। নিজের দেশ থেকেও এক দঙ্গল নিরাপত্তা বাহিনী পাঠায় বেশ কয়েকদিন আগে। এটা কি আমাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে ক্ষুণœ করে না? জনগণকে অবমাননা করা হয় না? আমাদের নিরাপত্তা নেই অথচ ওদের শুধু শুধু শ্যাম এলেই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। তা সত্ত্বেও মার্কিনী কোন প্রেসিডেন্ট একটি রাতও কাটায়নি। দিনে ঢাকায় কাটিয়ে নিরাপত্তার জন্য দিল্লীতে থাকতে হয়েছিল ক্লিনটনকে। কারণ এতসব পদক্ষেপ নিয়েও তার নিরাপত্তা নিñিদ্র নাকি হয়নি। ... জানি না, কেন ভয় ওদের মনে? কারণ বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে, অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে নানা কৌশলে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী ও ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবিদার দলের ওপর সওয়ার হয় এবং বাম বিরোধী কমিউনিস্ট প্রভাবিত জোট গঠন করে তাদের শায়েস্তা করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ‘ভেট’ দেয়।
ওরা নিজেদের গুরুত্ব আমাদের মনে চাপিয়ে দিয়ে আমাদের ‘বিক্রি’ হতে বাধ্য করে। আমরা অবশ্য বিক্রি হওয়ার জন্য রেডি হয়েই বসে থাকি। তাই তটস্থ হয়ে ওদের আদর-আপ্যায়ন, খানা-পিনা, আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার স্মারক, ঋণ চুক্তি ইত্যাদি স্বাক্ষর করে একেবারে বিকিয়ে দিই নিজেদের। দেশের বিভিন্ন সরকারই ঐ মার্কিনীদের মদদেই তো কট্টর কমিউনিস্ট চক্রকে সন্ত্রাসী বলে নস্যাত করে দিয়েছে। তাহলে এত ভয় কেন? তবে কি ভয় ওদের তাড়া করে বেড়ায়? কারণ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে না এবং যারা মানুষের পক্ষে তাদের সহ্য করা তাদের ধাতে সয় না। এদেশে তো ‘সন্ত্রাসী’ কমিউনিস্টরা নেই। প্রকাশ্যে যারা কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দেন, তারা তো সশস্ত্র বিপ্লবেও বিশ্বাস করেন না। তারা স্বাত্তিক সেজেছেন।
তাই বলছিলাম, হিলারি এসে ঢাকার রাজনীতিতে যে হাওয়া দিয়ে গেছেন, তাতে ক্ষমতার পক্ষ-বিপক্ষ উভয় দলই বেশ ‘দোদুল দোলনায়’ দুলছে। জাতীয় সঙ্কটে ওরা তো কাছে কখনও আসে না। এখন যে বিপদ আমরা ভাবছি, তাতে তাদের কোন তাপ-উত্তাপ নেই। বরঞ্চ হিলারির ‘হিলারিয়াস ট্যু’র তাদের বেশ আনন্দই দিয়েছে। কিন্তু মমতা প্রসঙ্গে যে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিল, তা কিন্তু তিনি করতে পারেননি অর্থাৎ তিস্তার ব্যাপারে তাঁকে আমাদের পক্ষে নয় সত্যের বাস্তবের পক্ষে আনতে পারেননি। মমতার মমত্ববোধ এখন আর এই বাংলাদেশের দিকে নেই। কারণ সামনের নির্বাচনের দিকে তার নজর। তাই সিপিএম ২৫ হাজার কিউসেক পানি যদি চেয়ে থাকে তবে তিনি চাইছেন ৫০ হাজার। অথচ তিস্তায় অত পানি আছে কি? এমন উদ্ভট দাবি তুলে মমতা তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইন অব্যাহত রাখছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। তাই হিলারিও ‘রা’ করেননি।
খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই সুপ্রিয় পাঠক, মমতা কিভাবে ভেল্কি দেখিয়ে হিলারিকে ভজিয়ে ফেলেছেন। খেয়াল করে দেখবেন, কংগ্রেস চাইছে প্রণব মুখার্জী ভারতের বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি তিনি হবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন প্রণব নয় মীরা কুমারি হবেন। এমনটি অন্য কোন রাজ্যসরকার করেনি। এই যে বিরোধিতার জোর কোথা থেকে পেলেন মমতা? নির্বাচনের আগে থেকে মার্কিনী মদদ যেভাবে তাকে শক্তি যোগান দিয়ে আসছে, তাতে তিনি কংগ্রেসকেই অগ্রাহ্য করতে চাইছেন। এমনকি জোট থেকে বেরিয়ে আসার হুমকিও দিয়েছেন।... তেমনি আমাদের দেশের বিরোধী দল তথা বর্তমান অষ্টাদশী চক্র (১৮ দল)-এর বিশাল নেত্রী খালেদা জিয়া ২০০৮ সালের নির্বাচনে গোহারা হেরে এমনি ক্ষেপেছিলেন ভোটারদের ওপর যার বর্ণনা দেয়ার দরকার নেই। সবাই আমরা জানি, যে ক’জন ভোট নিয়ে সত্যি সত্যি জিতেছেন, তারা যে কারণে জিতেছেন, অর্থাৎ মানুষের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের ভোট নিয়েছেন, সেই কাজটাই তারা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সংসদেই যাচ্ছেন না, লোকজন তো এর জন্যই ভোট দিয়েছিলেন। এতে করে যে ভোটদাতা জনসাধারণকেই অপমান করা হচ্ছে, তা তারা জেনেও নিজেদের কর্তৃত্ব খাটাবার মওকা খুঁজছিলেন। সরকারী দলের বড় কয়েকটি ব্যর্থতাই বিরোধী দলকে আবার সাধারণ মানুষের কাছে যেতে সাহস যুগিয়েছে। আর সামনেই নতুন নির্বাচন আসছে তাই দেখছি লবিং করে নতুন করে ক্ষমতায় যাবার আশায় রাজপথে নেমে হরতাল দিয়ে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে, জ্বালিয়ে, ভাংচুর করে, ‘জনদুর্ভোগ’ সৃষ্টি করে জনগণেরই সমর্থন চাইছে ওরা। এই রাজনীতির অবসান হবে কবে? মানুষ তবেই না স্বস্তি পাবেন?
বিদেশীদের কাছে নালিশ করলে ওরা পেয়ে যে বসে তাইতো গত ৬০/৬৫ বছর ধরে দেখে আসছি। ঐ পথ ত্যাগ করে নিজের দেশের সম্পদ বিপুল জনগোষ্ঠীকে নির্ভর করুন, তাঁদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন, তবেই সকল সংকট থেকে রেহাই পাবেন।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমাদের দেশের বিরোধী ১৮টি দলের নেত্রী মাদাম খালেদা জিয়া আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে সরকারের নামে নালিশ করে বোধহয় ‘বালিশ’ পেয়েছেন। সেই বালিশ ফাটিয়ে ফেলেছেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার জনসভায়। ফাটা বালিশের তুলো উড়িয়ে কী অসাধারণ উক্তিই না করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আগামী ৪২ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’... এই না হলে দেশের নেত্রী, দলের ম্যাডাম! কী চমৎকার হিসেব-নিকেশ কষে বলেছেন ৪২ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ২০ নয়, ৩০ নয় ৪০ও নয়, একেবারে নিখুঁত হিসেব করে ৪২ বছর পেলেন কোত্থেকে? এ হিসেব কোথাকার, কে দিয়েছে? সত্যিই সাধুবাদ দিতে হয় তাঁকে, কী চমৎকার অঙ্ক মিলিয়েছেন তিনি। এতদিন পর্যন্ত কোন নেতাই বলার সাহস করেননি, এই তো সেদিন হিলারির সঙ্গে ‘গুফতোগু’ হওয়ার পর নিখুঁত হিসেব জনগণের সামনে তুলে ধরলেন মাদাম জিয়া। একথা তাঁর মুখেই মানায়, কারণ তিনিই একমাত্র মহিলা। যিনি সামরিক জান্তা প্রধান জেনারেল জিয়ার হত্যার সুযোগে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বিকৃত তথ্য ও অসত্য ভাষণ দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে নির্বাচনে ভোট পাবার কসরত চালাচ্ছেন। অথচ জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকার সময় বঙ্গভবনে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে অভ্যাগত তিন ভদ্রমহিলা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সঙ্গে কথা বলছিলেন না খালেদা, এতই লাজুক ছিলেন। মিশুক ছিলেন না। এমন দৃশ্য দেখে দূরে অতিথিদের সঙ্গে আলাপরত জিয়া তাঁর স্ত্রী খালেদাকে কিছু একটা বলার জন্য তাঁর কাছে যান এবং বলে আবার অতিথিদের কাছে চলে আসেন। পরে ঐ ভদ্রমহিলাদের একজনার কাছ থেকে শুনেছিলাম, খালেদা জিয়া কথা না বলে দূরে একা দাঁড়িয়ে থাকায় জিয়া এসে তাঁকে শাসনের সুরে ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলেন। সেই খালেদা জিয়াই আজ হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ‘৪২ বছর’-এর মতন তার স্বপ্নের কথা বললেন। বলবেনই তো, এখন তো তিনি জিয়ার স্ত্রী সুবাদে রাজনীতি-সংসদীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকায় সাময়িক কিছু চমক দিয়ে জিয়া ভোলাতে চেয়েছিলেন মানুষকে। দেশবাসীও মেজর থেকে জেনারেল হওয়া জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও সময়কালীন কাহিনী-কর্মকা- কিছুই জানতেন না বলে জিয়াকে খুব সহজভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। তার পেছনে আরও একটি কারণ ছিল, সে হলো, মেজর জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে তাঁর জোয়ানদের নিয়ে পাকিস্তান থেকে সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়া জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার হুকুম তামিল করার জন্যই চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে ব্যারিকেড দেখে এগুতে না পেরে বন্দর শ্রমিকদের গালিগালাজ করেছিলেন এবং বন্ধুর মাধ্যমে বাঙালিদের ‘ডিসআর্ম’ করার খবর পেয়ে পালাবার সিদ্ধান্ত নেন। সীমান্ত অভিমুখে রওনা হন কিন্তু গ্রামবাসীরা পথরোধ করে ওদের পালাবার পথ বন্ধ করে দেন। ফলে ফটিকছড়িতেই থাকতে হয়েছিল। এদিকে বেতার ও শহরের সংস্কৃতি কর্মীরা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে পূর্ববাংলার শোষণ মুক্তির ঘোষণা দেন উপাধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। পক্ষে বক্তৃতা করেন সাংবাদিক আব্দুস সালাম। আরও কেউ কেউ। কিন্তু বেতার কর্মীদের মধ্যে সচেতন যাঁরা, তাঁরা ভাবলেন এই যুগসন্ধিক্ষণে একজন বাঙালি সামরিক অফিসারের কণ্ঠে যদি কোন আহ্বান বা তাদের সমর্থনের আভাস দেয়া যায় তবে বিপর্যস্ত বাংলার জনগণের প্রত্যয় সুদৃঢ় হবে। তাই বেতার উদ্যোক্তাদের একজন বেলাল মোহাম্মদ গিয়ে আশ্রিত গ্রাম থেকে তাঁকে শহরে নিয়ে আসেন। তাঁকে অনুরোধ করা হলে তিনি সুযোগ পেয়ে ‘আর্মি ক্যু’র ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এতে সাধারণভাবে বেতার সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী ও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী নেতাদের উদ্যোক্তারা বিব্রতবোধ করলেন। তাঁকে ডেকে আনাই হলো বাঙালি সৈন্যরাও এই বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সমর্থন করছেন, তা জানিয়ে দেয়ার জন্য। অথচ তিনি সুযোগ বুঝে ‘প্রভিশনাল সরকার’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বেতার সংগঠকরা তো বটেই তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে এটা ক্যু নয়, এ মুক্তিযুদ্ধ। এমনকি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে শিল্পমন্ত্রী একে খান এম আর সিদ্দিকীকে ডেকে বলেছিলেন, তাকে গিয়ে বলো, এটা আর্মি ক্যু নয়, রাজনৈতিক যুদ্ধ।
বহু কসরতের পর বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যে বিপ্লবী শব্দ ছিল, তা বাদ দিতে বললেন এবং তারপর একাত্তরের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মহান নেতা মেনে তাঁর নামেই স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করেছিলেন। ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ আমরা সবাই মেনে নিয়েছি, কিন্তু বিএনপি দাবি করছে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক’ এবং ২৬ মার্চ জিয়া এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। অবশ্য জিয়া জীবদ্দশায় তাঁর কোন বক্তৃতা বা লেখায়ও এমন দাবি কখনও করেননি। আর আওয়ামী লীগ কেন দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন এ দাবি অসত্য, অসার। কারণ যে কোন মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার লড়াই কিংবা বিপ্লব যেভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তা থেকে আমরা যা অনুধাবন করি যে, এমন কোন ঘোষণা সুনির্দিষ্টভাবে সেদিন আসেনি বা মেলেনি কোনভাবেই। মুক্তিযুদ্ধ বা বিপ্লব শুরু হয় সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই। একাত্তরে এমন কোন সিদ্ধান্ত ছিল কি? একাত্তরের মার্চ ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে উত্তাল এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল জনসাধারণ তাই রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে দারুণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তার পেছনে সবচেয়ে বড় এবং তাৎক্ষণিক কারণ ছিল, সামরিক শাসকদের দেয়া সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অকল্পনীয় বিজয় জাতীয় ও পূর্ববঙ্গ পরিষদে কিন্তু পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক শক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানী রাজনীতির প্রাসাদ ও সামরিক চক্রান্তকারী সিন্ডিকেটের ছিল না। কারণ যেভাবেই হোক তারা পূর্ববঙ্গের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি ছিল না। তাই কথা দিয়েও শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ করতে চায়নি। ফলে মানুষের মনে জমে ওঠা ক্রোধের সঙ্গে ন্যায্য অধিকার না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতি মিলে দেশবাসী বাংলার জনগণকে মুক্তির পথে হাঁটতে বাধ্য করেছিল। অর্থাৎ রাজনৈতিক পথপরিক্রমায়ই তো এই বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি। যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বই ‘সর্বজনগ্রাহ্য’ বিশেষ করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। তাই রাজনীতিই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল এবং দেশের সকল মানুষই এ ভূমিকায় প্রধান শক্তি বা নায়ক। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মুক্তিযুদ্ধ তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। বাংলার অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ঐ সময় বাংলার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে অনিশ্চিত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থাকে যূথবদ্ধ উদ্দেশ্যে নিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে সহায়তা কামনা করেন। কিন্তু এই উদ্যোগ আওয়ামী লীগে মুশতাক সমর্থক এবং যুব ও ছাত্র নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চাইল না। এমনকি তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রীকে হিসেবে গ্রহণ করতে চাইল না। চ্যালেঞ্জ করতে আগরতলায় দলের বিশেষ অধিবেশন কাউন্সিল ডেকে বসলেন। কিন্তু সংগঠন পর্যায়ে তাজউদ্দিনের যে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা এবং জনপ্রিয়তা ছিল, বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হিসেবে, তার কাছে অনাস্থা উত্থাপনকারীরা হেরে গেলেন।... বহু চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাজউদ্দিন আহমদই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘সচিবালয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন মন্ত্রিসভার অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যৌথভাবে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে সরাসরি রণাঙ্গনে মুক্তি সেনাদের সঙ্গে থেকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এই পর্যায়ে দেশ এবং পরদেশেও তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিসমাপ্তির পথে নিয়ে গিয়েছিলেল এই তাজউদ্দিন আহমদই। আমরা তাঁর নেতৃত্বেই বিজয়ী হয়েছি এ কথা অনস্বীকার্য।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খোন্দকার মুশতাকরা ফাঁক-ফোকর খুঁজে ভেতরটাকে ‘ফোকলা’ করে দেবার যে তৎপরতা চালিয়েছিল, তাজউদ্দিন সাহেবের দৃঢ় মনোবলের এবং মুক্তিফৌজের অসম সাহসিকতা ও বিজয়াভিযানের ফলে তাকে ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিল বটে, কিন্তু পরাশক্তি ঐ সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার কোন মুক্তিযুদ্ধকেই কোনদিন সমর্থন জানায়নি, তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও প্রবল বিরোধিতা করেছিল। মুক্তি ফৌজের বিজয়ে আপাতদৃষ্টিতে মার্কিনীরা পিছিয়ে গিয়েছিল, তা বলা যাবে না। বরঞ্চ গোপনে খাল কাটছিল। তারই ফসল হিসেবে দেখলাম, ধর্মনিরপেক্ষতার সেøøাগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিজয় অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামী দেশগুলোর সম্মেলনে যোগ দিতে বাধ্য হলেন। মুক্তিযুদ্ধের চিরশত্রু আমেরিকান প্রশাসন-শাসকগোষ্ঠী যেন পেয়ে বসলো বাংলাদেশকে। আর বিগত চল্লিশ বছরে কত না ফন্দিতে নবীন রাষ্ট্র ও নেতৃত্বকে কতভাবে বেকায়দায় ফেলে কব্জা করার মতলব এঁটেছে। আজ তারই খেসারত প্রতিনিয়ত দিয়েই চলেছি। ...ওদের চরিত্র দুধারী তলোয়ারের মতন অথবা ‘দোদিল বান্দা’র বলা যায়। ‘চোরকে চুরি করতে বলে গেরস্থকে সজাগ থাকতে বলে।’ দুনিয়ার সর্বত্রই একই নীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে বিক্রি করার জায়গা খুঁজতেও ওদের যুদ্ধের প্রয়োজন। তাই যুদ্ধ বাঁধিয়ে দুই দেশকেই যুদ্ধাস্ত্র সাপ্লাই দিতে ওস্তাদ। সেই আমেরিকান প্রশাসন আজও আরামসে ঘাড় মটকে খেয়ে যাচ্ছে। তাদেরই বর্তমান চক্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এসেছিলেন চীন আর ভারত সফরে। মাঝখান দিয়ে বাংলাদেশেও ঢুঁ মেরে গেছেন। এই সুযোগ নিয়ে খালেদা জিয়া ‘নালিশ’ করেছেন সরকারের বিরুদ্ধে।... আচ্ছা, মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, বিদেশের কাছে নিজেদের ‘হাঁড়ির খবর’ বলে আমরা কি লাভ পাই, কিন্তু কেন করেন? এতে কি দেশের সম্মান বাড়ে? যদি না বাড়ে তবে কেন জনগণকে এভাবে অপমান করেন? মনে রাখবেন, জনগণ অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত। চোখ বন্ধ করে থাকবেন না। ভাববেন না, চোখ যখন বন্ধ এখন কেউ দেখতে পাচ্ছে না।... আমরা কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। কারণ আমাদের কোন সার্থকতা নেই, কিন্তু আপনারা তো ক্ষমতাকে টার্গেট করেই রাজনীতিও করেন। ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া আর কোন কথা ভাবতেও পারেন না। আর ক্ষমতায় যাবার জন্যে যা খুশি করতে আপনাদের বাধে না। সে কারণে যার যা খুশি তাই বলেন, একে অপরের বিরুদ্ধে। নিজের দেশের প্রতি যদি সত্যিই আনুগত্য থাকে তবে কেন অন্যের ওপর নির্ভর করেন? কেউ টাকা না দিলে দেশ চলবে না এটা মনে জায়গা পায় কেন? আমরা কি আদৌ দরিদ্র। না রাজনৈতিক কারণে গরিব বানিয়ে রাখা হয়েছে?
এমনই মানসিকতা আপনাদের মনে বাসা বেঁধেছে। কারণ আপনারা রাষ্ট্র পরিচালনা ও ক্ষমতারোহণ করার মদদ বা শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থেকেই পেতে চান। কখনও বা মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরব ও প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থসম্পদ বোধহয় আপনাদের আকৃষ্ট করে। তাই আপনারা একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ করে ফায়দা হিসেবে ক্ষমতায় গেলে তাদের সাহায্য নিয়ে যেন কাজ করতে পারেন। ...সে কারণেই দেখি, মার্কিনীরা মন্ত্রী বা তস্য মন্ত্রী কিংবা আন্ডার সেক্রেটারি যখন আসেন, তথা ক্ষমতাসীন সরকার যেই থাকে, তারাই উন্মাদ হয়ে যান। কত যে নিরাপত্তাই না নেয়া হয়, কত যে তার স্তর থাকে! তাতেও ভরসা পায় না। নিজের দেশ থেকেও এক দঙ্গল নিরাপত্তা বাহিনী পাঠায় বেশ কয়েকদিন আগে। এটা কি আমাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে ক্ষুণœ করে না? জনগণকে অবমাননা করা হয় না? আমাদের নিরাপত্তা নেই অথচ ওদের শুধু শুধু শ্যাম এলেই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। তা সত্ত্বেও মার্কিনী কোন প্রেসিডেন্ট একটি রাতও কাটায়নি। দিনে ঢাকায় কাটিয়ে নিরাপত্তার জন্য দিল্লীতে থাকতে হয়েছিল ক্লিনটনকে। কারণ এতসব পদক্ষেপ নিয়েও তার নিরাপত্তা নিñিদ্র নাকি হয়নি। ... জানি না, কেন ভয় ওদের মনে? কারণ বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে, অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে নানা কৌশলে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী ও ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবিদার দলের ওপর সওয়ার হয় এবং বাম বিরোধী কমিউনিস্ট প্রভাবিত জোট গঠন করে তাদের শায়েস্তা করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ‘ভেট’ দেয়।
ওরা নিজেদের গুরুত্ব আমাদের মনে চাপিয়ে দিয়ে আমাদের ‘বিক্রি’ হতে বাধ্য করে। আমরা অবশ্য বিক্রি হওয়ার জন্য রেডি হয়েই বসে থাকি। তাই তটস্থ হয়ে ওদের আদর-আপ্যায়ন, খানা-পিনা, আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার স্মারক, ঋণ চুক্তি ইত্যাদি স্বাক্ষর করে একেবারে বিকিয়ে দিই নিজেদের। দেশের বিভিন্ন সরকারই ঐ মার্কিনীদের মদদেই তো কট্টর কমিউনিস্ট চক্রকে সন্ত্রাসী বলে নস্যাত করে দিয়েছে। তাহলে এত ভয় কেন? তবে কি ভয় ওদের তাড়া করে বেড়ায়? কারণ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে না এবং যারা মানুষের পক্ষে তাদের সহ্য করা তাদের ধাতে সয় না। এদেশে তো ‘সন্ত্রাসী’ কমিউনিস্টরা নেই। প্রকাশ্যে যারা কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দেন, তারা তো সশস্ত্র বিপ্লবেও বিশ্বাস করেন না। তারা স্বাত্তিক সেজেছেন।
তাই বলছিলাম, হিলারি এসে ঢাকার রাজনীতিতে যে হাওয়া দিয়ে গেছেন, তাতে ক্ষমতার পক্ষ-বিপক্ষ উভয় দলই বেশ ‘দোদুল দোলনায়’ দুলছে। জাতীয় সঙ্কটে ওরা তো কাছে কখনও আসে না। এখন যে বিপদ আমরা ভাবছি, তাতে তাদের কোন তাপ-উত্তাপ নেই। বরঞ্চ হিলারির ‘হিলারিয়াস ট্যু’র তাদের বেশ আনন্দই দিয়েছে। কিন্তু মমতা প্রসঙ্গে যে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিল, তা কিন্তু তিনি করতে পারেননি অর্থাৎ তিস্তার ব্যাপারে তাঁকে আমাদের পক্ষে নয় সত্যের বাস্তবের পক্ষে আনতে পারেননি। মমতার মমত্ববোধ এখন আর এই বাংলাদেশের দিকে নেই। কারণ সামনের নির্বাচনের দিকে তার নজর। তাই সিপিএম ২৫ হাজার কিউসেক পানি যদি চেয়ে থাকে তবে তিনি চাইছেন ৫০ হাজার। অথচ তিস্তায় অত পানি আছে কি? এমন উদ্ভট দাবি তুলে মমতা তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইন অব্যাহত রাখছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। তাই হিলারিও ‘রা’ করেননি।
খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই সুপ্রিয় পাঠক, মমতা কিভাবে ভেল্কি দেখিয়ে হিলারিকে ভজিয়ে ফেলেছেন। খেয়াল করে দেখবেন, কংগ্রেস চাইছে প্রণব মুখার্জী ভারতের বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি তিনি হবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন প্রণব নয় মীরা কুমারি হবেন। এমনটি অন্য কোন রাজ্যসরকার করেনি। এই যে বিরোধিতার জোর কোথা থেকে পেলেন মমতা? নির্বাচনের আগে থেকে মার্কিনী মদদ যেভাবে তাকে শক্তি যোগান দিয়ে আসছে, তাতে তিনি কংগ্রেসকেই অগ্রাহ্য করতে চাইছেন। এমনকি জোট থেকে বেরিয়ে আসার হুমকিও দিয়েছেন।... তেমনি আমাদের দেশের বিরোধী দল তথা বর্তমান অষ্টাদশী চক্র (১৮ দল)-এর বিশাল নেত্রী খালেদা জিয়া ২০০৮ সালের নির্বাচনে গোহারা হেরে এমনি ক্ষেপেছিলেন ভোটারদের ওপর যার বর্ণনা দেয়ার দরকার নেই। সবাই আমরা জানি, যে ক’জন ভোট নিয়ে সত্যি সত্যি জিতেছেন, তারা যে কারণে জিতেছেন, অর্থাৎ মানুষের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের ভোট নিয়েছেন, সেই কাজটাই তারা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সংসদেই যাচ্ছেন না, লোকজন তো এর জন্যই ভোট দিয়েছিলেন। এতে করে যে ভোটদাতা জনসাধারণকেই অপমান করা হচ্ছে, তা তারা জেনেও নিজেদের কর্তৃত্ব খাটাবার মওকা খুঁজছিলেন। সরকারী দলের বড় কয়েকটি ব্যর্থতাই বিরোধী দলকে আবার সাধারণ মানুষের কাছে যেতে সাহস যুগিয়েছে। আর সামনেই নতুন নির্বাচন আসছে তাই দেখছি লবিং করে নতুন করে ক্ষমতায় যাবার আশায় রাজপথে নেমে হরতাল দিয়ে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে, জ্বালিয়ে, ভাংচুর করে, ‘জনদুর্ভোগ’ সৃষ্টি করে জনগণেরই সমর্থন চাইছে ওরা। এই রাজনীতির অবসান হবে কবে? মানুষ তবেই না স্বস্তি পাবেন?
বিদেশীদের কাছে নালিশ করলে ওরা পেয়ে যে বসে তাইতো গত ৬০/৬৫ বছর ধরে দেখে আসছি। ঐ পথ ত্যাগ করে নিজের দেশের সম্পদ বিপুল জনগোষ্ঠীকে নির্ভর করুন, তাঁদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন, তবেই সকল সংকট থেকে রেহাই পাবেন।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব