পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

জিএম ইয়াকুবের আজ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী

কামাল লোহানী
জিএম ইয়াকুবের আজ (৩০ মে) প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। যে ইয়াকুব নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেছিলেন প্রদীপ্ত যৌবনে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, সেই দক্ষ সংগঠনটিকে কেউ বুঝি মনেই রাখেনি কিংবা রাখতে চায় না। ইয়াকুব যখন সাংবাদিকতায় আসেন, তখন ছিল জাতির জীবনে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। গোটা পূর্ববঙ্গবাসী মুক্তির লক্ষ্যে নিজেদের প্রস্তুত করেছে এবং এই মহতী লড়াইয়ে এই ব্যক্তিটির কী অসাধারণ অবদান ছিল তা আজ কারও মনে থাকতে না পারে, কিন্তু তার ভূমিকায় কোন ছেদ ছিল না। সাংবাদিকতা বিষয়টিকে বেছে নিয়েছিলেন জিএম ইয়াকুব জীবনমুক্তি আর সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে। আন্তরিকতা আর দেশপ্রেম তাকে প্রবলভাবে উৎসারিত করেছিল।
জিএম ইয়াকুবের মৃত্যু হয়েছে ক্যান্সারে, সেও মাত্র এক বছর। কিন্তু মনে হয় যেন তাকে ভুলে গেছেন সবাই। ভীষণ ক্ষোভ তার স্ত্রীর। যে মানুষটি এমন ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিক ইউনিয়নকে সময় দিয়েছেন, সহকর্মীদের ভালবেসেছেন, শ্রদ্ধা করেছেন, সেই মানুষটি একেবারে ‘অচেনা’ কেন হয়ে গেলেন? তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত আজ থেকে বহু বছর আগেই বলেছিলেন, ‘মানুষের শোকের আয়ু মাত্র দশ দিনের।’ মানুষের কবি, সমাজ বদলের মহান যোদ্ধা, জীবন বাস্তবতায় বিশ্বাসী আদর্শিক রাজনীতির এই লড়াকু কবির কথা আজ আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের লড়াই করেই বাঁচতে হবে। সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নেবে, তখন নিজেকেই দৃঢ় সংকল্প নিবদ্ধ করতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতি দুর্দান্ত প্রতাপের দেশে মানুষের বিপণœতা কারো মনে দাগ কাটে না। এখন বুঝি এমনি সমাজব্যবস্থা এবং মানুষের মন।
জিএম ইয়াকুব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যেমন ছিলেন তার পাঁচ ভাইও। বড় দুু’জনকে তো আমি চিনতাম, তাদের মন-মানসিকতা, আদর্শিক চিন্তা-ভাবনার কারণে। ইয়াকুবও তাই। হয়ত অন্যরাও বড়দের পথই অনুসরণ করেছেন। বড় ভাই আমাদের প্রিয়পাত্র ছিলেন। মোর্তজা আমার সমসাময়িক। বাষট্টিতে জেলও খেটেছি একসঙ্গে। ওরা দু’জনাও নেই। ইয়াকুবও চলে গেছে স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে। বড় ছেলে তার বিয়ে করে সংসার জীবনযাপন করছে। ছোট ছেলেটি পড়াশোনা করছে, কিন্তু সঙ্কট সামনে এসে দাঁড়ালে হয়তবা হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাবে সেও। বাবা-চাচারাও তো সকল সঙ্কটকে মোকাবেলা করেই জীবন গঠন করেছিলেন। তাদের পরিণতি নয়, আদর্শকে ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। বাবা জিএম ইয়াকুব বা তাঁর মতো মানুষেরা শুধু ত্যাগ করেছেন। জীবনে কোন লোভ-লালসা তাঁদের ‘ছোট’ করতে পারেনি। ইয়াকুব ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দক্ষ সংগঠক। ৯নং সেক্টরের সাহসী যোদ্ধা-মুক্তিসেনা।
সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি দৈনিক সংবাদে। প্রথমে সংশোধনী বিভাগে, তারপর সহ-সম্পাদক পদে উন্নীত হয়েছিলেন। একমাত্র ‘সংবাদ’ এই সাংবাদিকতা করেছেন তিনি। কিন্তু ইয়াকুবের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে সংবাদ ছেড়ে দিতে হয় পত্রিকার অর্থ সংকটের কারণে। তারপর তিনি আর কোন পত্রিকায় যোগ দেননি। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন এবং পরিষদ প্রকাশিত মাসিক ‘মুক্তি’ সম্পাদনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। জিএম ইয়াকুব মারা যাওয়ার আগে ঢাকায় ‘প্রগতিশীল সাংবাদিক ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। তারও অভিভাবক হিসেবে ছিলেন। সাংবাদিক ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে সংবাদ ইউনিটের ডেপুটি চীফ এবং পরে ইউনিট চীফ হন। তারও অনেক পরে তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১৯৯৬ সালে রিপোর্টার্স ইউনিটের আয়োজনে শেখ হাসিনার হাত থেকে সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন। ২০০৭ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড যে বিজয় উৎসব পালন করে তিনদিন, সেখানে ইয়াকুব আমন্ত্রিত হয়েছিল ২০০৭ সালে।
এই জিএম ইয়াকুব সম্ভবত জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময়ই সাংবাদিকতার সংস্পর্শে আসেন। এ সময় ছাত্রনেতা হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে প্রথম গ্রেফতার হন। পরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও যখন মার্কিনী চক্রান্ত অব্যাহতভাবে চলছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৪ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হলো, তার পরপরই ইয়াকুবও বহু বঙ্গবন্ধু অনুসারী এবং মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কারাবরণ করেন।
খুবই পরিতাপের বিষয়, জিএম ইয়াকুব একজন নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিসংগ্রামী ছিলেন পাকিস্তান আমলে দুঃশাসনবিরোধী গণআন্দোলনের শরিক হিসেবে। শুধু কি তাই, মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরে সাহসিকতার সঙ্গে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করে ছিলেন জানকে বাজি রেখে। কিন্তু মৃত্যুকালে এই মুক্তিযোদ্ধা যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে সমাহিত হননি। এমনকি তাঁর যে মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ছিল সেটিও ১৯৮৮ সালের সর্বগ্রাসী বন্যায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। পরে এই সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে নতুন করে সনদপত্র জারি করার জন্য আবেদন জানানো হয় তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে। আজ পর্যন্ত সেই সনদপত্র সোনার হরিণ হয়েই রয়ে গেছে তাঁর পরিবারের কাছে। জিএম ইয়াকুব প্রগতিশীল নানা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তো জাতির, দেশবাসীর সবারই অহংকার, গর্ব। সেই গর্বে উদ্দীপ্ত হতে চায় পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম। যে পরিবারের পাঁচ ভাই-ই মুক্তিযোদ্ধা, তাদেরই একজন জিএম ইয়াকুব। তাঁরই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তাঁর উত্তরাধিকারীরাও গর্বিত হতে চায়। আর সে প্রাপ্তিটুকুও এই গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকেই পেতে চায়।
কিন্তু এমনি এক নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিককর্মীর দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রামের সাহসী যোদ্ধা, যার অস্ত্র ঝলসে উঠেছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ৯নং সেক্টরের রণাঙ্গনে, তারই পাকস্থলিতে ধরা পড়ল ক্যান্সার। সে তো ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১। এই তো গত বছর মাত্র। বারডেমে ভর্তি করা হয়েছিল কারণ ডা. আজাদ খান বলেছিলেন, তাঁকে অপারেশন করতে হবে। কিন্তু ভর্তি হবার পর দেখা গেল অপারেশন করার পর্যায়ে নেই তাঁর অবস্থা, ফলে বাড়িতে নিয়ে আসার পর ৩০ মে ২০১১-তে তিনি পরলোকগমন করেন। প্রচুর অর্থব্যয়ে চিকিৎসা করতে গিয়ে পরিবারেও নেমে এসেছে অর্থ সঙ্কট। বন্ধুদের যৎসামান্য সাহায্য পেলেও এখনও তার ধকল দূর করতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। ব্যাহত হচ্ছে লেখাপড়া।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন